চলছে টমেটো চাষের সময়। বাংলাদেশে এটি বিলাতি বেগুন নামেও পরিচিত। এই সবজির জনপ্রিয়তা খুব বেশি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু বলে। আধুনিক পদ্ধতি ও উন্নত জাতের টমেটো চাষ করলে ফলন অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে আর্থিকভাবে লাভবানের পাশাপাশি পরিবারের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করা যায়।
মাটি ও জলবায়ু: সব ধরনের মাটিতে টমেটোর চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গাছে টমেটো ভাল জন্মে। তাই বাংলাদেশে শীতকালে টমেটো চাষের জন্য উপযুক্ত সময়।
জাত: টমেটোর অনেক জাত রয়েছে। যেমন- রুমা, মানিক, রতন, ভি এফ, সানমারজানো, অক্সহার্ট, মারগ্লোব, বারি টমেটো-৩, বারি টমেটো-৫, অপূর্ব, শিলা, অনুপমা, বিনা টমেটো-২, বিনা টমেটো-৩, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ: জমি ৪ থেকে ৫ বার চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করে নিতে হবে। বীজ রোপণের ৩০ থেকে ৪০ দিন পর চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। প্রতিটি সারিতে ২ সারি করে চারা লাগাতে হবে। চারা রোপণের দূরত্ব সারি থেকে সারি ৬০ সেন্টিমিটার, চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়।
সার প্রয়োগ: টমেটোর ভাল ফলনের জন্য সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর বা কম্পোস্ট সার হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৭ টন। ইউরিয়া ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি। টিএসপি ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি। এমপি ২০০ থেকে ৩০০ কেজি। কাইসেরাইট ৪০ থেকে ৫০ কেজি।
সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, এমপি, কাইনেরাইট এর অর্ধেক ইউরিয়া ইত্যাদি সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার সমান দুই কিস্তিতে চারা লাগানোর ১৫ ও ৩০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা: প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির সার প্রয়োগের আগে পার্শ্বকুশিসহ মরাপাতা ছাটাই করে দিতে হবে। হরমোন প্রয়োগ সুবিধা এবং বাতাসে যেন হেলে না পড়ে সেজন্য বাঁশের কঞ্চি দ্বারা ঠেকনা দিতে হবে। প্রয়োজনে নিড়ানী দিতে হবে এবং মাটির উপরিভাগ আলগা করে দিতে হবে। ফলে আলো-বাতাস প্রবেশের সুবিধাসহ মাটি রস বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে। ৪ থেকে ৬ বার সেচ প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে হবে। তবে চারা লাগানোর ৩ থেকে ৪ দিন পর হালকা এবং পরবর্তীতে প্রতি কিস্তি সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে।
পোকা দমন: টমেটোর মূলত দু’টি পোকা অধিকহারে ক্ষতি করে থাকে যথা- জাব পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। জাব পোকা টমেটোর গাছের পাতা, কচি ডগা ও কাণ্ড থেকে রস শুষে খেয়ে গাছের ক্ষতি করে এবং গাছে মোজাইক রোগ ছড়ায়। এ পোকা দমনে ১০০০ লিটার পানির সাথে রগোর এল-৪০/সাইফানন ৫৭ ইসি বা ক্লাসিক-২০ ইসি মিশিয়ে প্রতি হেক্টর জমিতে সেপ্র করতে হবে। অন্যদিকে ফল ছিদ্রকারী পোকার কীড়া টমেটো ছিদ্র করে ভেতরে ঢোকে এবং কুড়ে কুড়ে খায় ফলে আক্রান্ত ফল খাওয়ার অনুপযুক্ত করে ফেলে। এ পোকা দমনের জন্য প্রথমত আক্রান্ত পাতা ও ফল সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। যদি বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হয় তবে ফরাটাপ বা কেয়ার ৫০ এসপি ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছের সমস্ত অংশ সেপ্র করতে হবে। তাছাড়াও বাইকাও-১ প্রয়োগ করে পোকা দমন করা যেতে পারে।
রোগ দমন: টমেটোর ঢলে পড়া রোগ লাল মাটিতে চাষ করলে বেশি পরিমাণে হতে পারে তাই চাষ করার আগে জমি নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে এবং পরিমিত সেচ দিতে হবে। টমেটোর আগাম ধ্বসা রোগের ফলে গাছের পাতা একসময় সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় ফলে ফসল মারাত্মক ক্ষতি হয়। তাই রোগমুক্ত বীজ ও চারা রোপণ করতে হবে এবং প্রয়োজনমত কৃষিবিদের সাহায্য নিতে হবে। টমেটোর নাবী ধ্বসা রোগের কারণ ছত্রাক। এ রোগ অনেকটা আগাম ধ্বসা রোগের মত তাই একই রকম রোগ দমনে একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ভাইরাসের কারণে টমেটোর মোজাইক রোগ এবং বুশি স্টান্ট রোগে আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে এবং প্রয়োজনে কৃষিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।
টমেটোর শেকড়ের গিট রোগে হেক্টরপ্রতি ৬০ জি ফুরাফুরান বা কেয়ার ৪ জি ৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ: চারা লাগানোর ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে টমেটোর ফল সংগ্রহ করা যায় এবং প্রতি গাছ থেকে ৭ থেকে ৮ বার ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় তোলা যায়।
ফলন: হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০ থেকে ৪০ টন পর্যন্ত হয়।
লেখক: কৃষিবিদ মোঃ শাহীন আলম